তবে কি হাল ছেড়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ?
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:২০:৪৮,অপরাহ্ন ৩০ মে ২০২০ | সংবাদটি ৯৪১ বার পঠিত
আতিক মাহামুদ রোমেল
আগামী ৩০ মে’র পর থেকে দেশে সাধারণ ছুটির মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছে সরকার। সেই সাথে, ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সীমিত আকারে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি অফিসগুলো নিজ ব্যবস্থায় খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ থেকে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। অবশ্য এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন একটি বেসরকারি চ্যানেলে ছুটির মেয়াদ না বাড়ানো এবং সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দেয়ার ইঙ্গিত দেন। এর একদিন পরই এমন একটি নির্দেশনা জারি করা হলো।
নির্দেশনা মতে, শর্তসাপেক্ষে নিজ নিজ ব্যবস্থায় ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সীমিত আকারে সব সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিসগুলো খোলা থাকবে। সীমিত পরিসরে নির্দিষ্টসংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে গণপরিবহন, যাত্রীবাহী নৌযান ও রেল চলাচল করতে পারবে। অভ্যন্তরীণ কয়েকটি রুটের বিমান চলতে পারবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দোকানপাট, হাট-বাজার, শপিংমল বিকাল চারটা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ থাকবে।
দেশে নভেল করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের হার বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। এরপর কয়েক দফা ছুটি বাড়িয়ে অবশেষে দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় পর সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত এলো। অবশ্য এর আগে গত ২৬ এপ্রিল করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই গার্মেন্টস শিল্পসহ উৎপাদনমুখী সব কলকারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাকরি বাঁচানোর তাগিদে গণপরিবহন না পেয়ে প্রায় শতমাইল পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে ফিরতে দেখা যায় শ্রমিকদের, যা নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছিল।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সরকার এই নির্দেশনা এমন একটি দিনে জারি করেছে যেদিন দেশে কোভিড- ১৯ এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দুই হাজার ছাড়িয়েছে এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজারে। শুক্রবার আক্রান্ত হয়েছে আরো ২ হাজার ৫২৩ জন। মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক। সীমিত পরীক্ষার মধ্যেও প্রতিদিন প্রায় ২০-২২% হারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্যখাত প্রায় ভেঙে পড়েছে এবং চিকিৎসার সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চিকিৎসা পাচ্ছেনা সাধারণ মানুষ। করোনা আক্রান্ত রোগীদেরও যেন দুর্ভোগের অন্ত নেই। শতকরা ৯০ ভাগ রোগীকেই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার বাহিরে রাখা হচ্ছে। যে দশভাগ হাসপাতালে সেবা পাচ্ছেন, তারাও সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, দায়িত্বে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আনছেন। ফলে এমন এক পরিস্থিতিতে সরকারের এই সিদ্ধান্তে জনমনে ক্ষোভ, আতঙ্ক ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তবে কি সরকার করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে? জীবিকার দোহাই দিয়ে জীবনকে উপেক্ষা করা হচ্ছে?
তবে কারো কারো মতে, সরকার মূলত দুইটি বিষয়কে মাথায় রেখে ঝুঁকি সত্বেও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক হলো, সরকার হয়ত খুব শিগগিরই কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর একটি টিকা হাতে পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। অন্যটি হলো, হার্ড ইমিউনিটি তৈরির সুযোগ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা। তবে উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যার ফলস্বরূপ চরম মূল্য দিতে হতে পারে জাতিকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরির জন্য এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১২৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিই চীনের। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো টিকাই চূড়ান্ত আলোর মুখ দেখেনি। কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে তা-ও নির্দিষ্টভাবে কোনো গবেষক বলতে পারছেন না। তবে কয়েকটি টিকা নিয়ে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছে বিশ্ব। আশা করা হচ্ছে হয়ত সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ অন্তত একটা টিকা বাজারে আসতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছে, ২০২১ এর আগে টিকা বাজারে আসার সম্ভাবনা নাই। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এমনও আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে যে, অন্যান্য অনেক ভাইরাসের মত হয়ত করোনাভাইরাসের টিকাও কখনোই পাওয়া যাবে না। যদি এমনটা হয় অথবা টিকা হাতে পেতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় তাহলে দেশে যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হবে তা সামাল দিতে সরকার কতটুকু প্রস্তুত, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
অন্যদিকে, হার্ড ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির কথা বলা হচ্ছে। হার্ড ইমিউনিটি দুইভাবে তৈরি হয়। এক ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে, অন্যটি হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে। যেহেতু করোনার ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কার হয়নি সেহেতু প্রাকৃতিকভাবে ইমিউনিটি তৈরি হবে এটাই আমাদের ভরসা। তবে এর জন্য জাতিকে এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। করোনা সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক দেশ হার্ড ইমিউনিটির পথে চলতে চেয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপকতা তাদের স্ট্রাটেজি পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে হার্ড ইমিউনিটি বাংলাদেশকে কতটা সুরক্ষা দেবে?
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে হলে ৭০ থেকে ৮০ ভাগের বেশি মানুষ এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি ৭০% মানুষও সংক্রমিত হতে হয় তাহলে বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হবে। সংখ্যাটা অকল্পনীয় মনে হলেও ঠিক উড়িয়ে দেয়া যায়না। এখন পর্যন্ত আমাদের গড় মৃত্যুর হার ২% হিসেবে ধরলেও প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আক্রান্ত ৫% রোগীও যদি হাসপাতালে আসতে হয় তাহলে সে সংখ্যাটি দাঁড়ায় প্রায় ৬০ লাখ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হাসপাতালসমূহ এই লাখ লাখ রোগীকে স্থান দেয়া এবং চিকিৎসা সেবা দেয়ার সামর্থ্য কতটুকু আছে? আর তার জন্য সরকারের প্রস্তুতিই বা কি? এসব বিষয় স্পষ্ট হওয়া জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী লকডাউন তুলে নেয়া কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তখনই চালু করা যাবে যখন করোনা ভাইরাস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে অথবা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার নিম্নমুখী থাকবে। বিশ্বব্যাপী এই গাইডলাইনই মেনে চলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ এর সুফল পেয়েছে এবং পাচ্ছে। করোনার আঁতুড়ঘর চীনের উহান এই পদ্ধতিতেই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল, যা এখন বিশ্বব্যাপী রোল মডেল হিসেবে পরিগনিত হচ্ছে। কঠোর লকডাউন মেনে নিউজিল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান, ভিয়েতনামের মত দেশগুলো সংক্রমণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছে। ইউরোপও সেই পথেই হাঁটছে।
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি এর ঠিক বিপরীতমুখী। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ঝুঁকিও বেড়েই চলছে। এ কথা স্বীকার করেছেন খোদ দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। গত ২৪ মে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে তিনি বলেন, দেশে করোনা ঝুঁকি বেড়ে গেছে। ঈদ পরবর্তী আগামী পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে দেশে করোনার ঝুঁকি আরো বাড়বে। প্রয়োজনে সরকারকে কারফিউ দিতে হবে বলেও মনে করছেন তিনি।
এদিকে, করোনা প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় গঠিত ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’র পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ এবং সদস্য সচিব আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা হলো রোগ সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করলে রোগের হার বাড়ার আশঙ্কা থাকে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য বিধি–বিধানগুলো সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ না করে শিথিল করা হলে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
দেশে করোনা সংক্রমণের এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে বিশেষজ্ঞগণ যখন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বার বার সতর্ক করার চেষ্টা করছে, কঠোর লকডাউনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে তখন সরকার সেদিকে না গিয়ে বরং সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়া এমন একটি সিদ্ধান্তে দেশব্যাপী ব্যাপক উৎকন্ঠা তৈরি হয়েছে। যেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকর ঔষধ আবিষ্কার হয়নি, টিকা আবিষ্কার হয়নি, সেখানে এই ভাইরাসের ভয়াবহতা উপেক্ষা করে এটা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে এবং দেশকে মহা বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমতাবস্থায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তবে কি হাল ছেড়ে দিচ্ছে সরকার? হাল ছেড়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ?
লেখক: সাংবাদিক, সোস্যাল এক্টিভিস্ট, সংগঠক- দুর্নীতি প্রতিরোধ মঞ্চ।