ছাত্র না শিক্ষা পদ্ধতি ?
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:০৮:০৮,অপরাহ্ন ০১ জুন ২০২০ | সংবাদটি ৯৭০ বার পঠিত
একজন প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে আমি কিছু কথা বলতে চাই , যদিও পত্রিকার পাতায় শুধু কে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেল , কে জিপিএ 5 পেল তারই খবর পাই । কিন্তু এসব খবরের ভিড়ে হারিয়ে যায় সেইসব পাশ না করতে পারা হাজারও ছাত্রের কান্না যারা পরীক্ষায় ফেল করেছে বলে পরিবারের কাছে নির্যাতিত হয় । পত্রিকার পাতায় কেউ বলে না ‘আমার জন্য দোয়া করবেন । আমি এই বৎসর S.S.C তে ফেল করেছি । আপনারাই বলুন এটা কি আমার দোষ না প্রচলিত শিক্ষা ব্যাবস্থার ত্রুটি? ‘
আপনার ছেলে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করেনি, আপনার প্রতিবেশী ছেলে পেয়েছে শীর্ষতম রেজাল্ট । আপনি হয়তোবা কল্পনার চোখে ভবিষ্যতের চিত্রকল্প দেখছেন , আপনার বিশাল গেইট শূন্য ,পাশের বাড়ীর গেইটে ঝুলছে বড় নিমপ্লেইট , লিখা প্রতিবেশীর ডাক্তার ছেলের নাম ,অনেক দেশী বিদেশী ডিগ্রী ,মানুষরা প্রশংসার চোখে দেখছে ।আর সেই জায়গায় এত এত প্রাইভেট পড়িয়ে আপনার ছেলে গড় রেজাল্ট করেছে ।আপনার মেয়ের নাম হয়তো তানিয়া , আপনি কল্পনা করছিলেন আপনার মেয়ের বাড়ীর দেয়ালের বেদীতে জ্বলজ্ল করে লিখা থাকবে বারিষ্টার তানিয়া , সেইসাথে দেশ বিদেশ থেকে আনা বিভিন্ন ক্যাটাগরীর ডিগ্রী । সেই তানিয়া আজ ভূগোলে পাশ মার্ক পায়নি বলে এস . এস . সিতে ফেল করেছে, যদিও প্রতিটি সাবজেক্টে সে দারুন স্কোর তুলেছে । আপনি কাঁদছেন , আপনার কান্না দেখে দুখী মেয়ে আরও বেশী কাঁদছে ,হয়তো সে দরজা লাগিয়ে খীল আটকে বসে আছে । আপনাদের বলছি পৃথিবীর সবাই যদি ডাক্তার , ইন্জিনইয়র আর বারিষ্টার হয়ে যায় তাহলে সমাজের সামগ্রীক কাঠামো চলবে কিভাবে ? আর যে সব ছাত্র ডাক্তার বারিষ্টার হতে পারে না তারা কি সম্মানিত , সুখী জীবন কাটাতে পারছে না । যারা কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারে নাই তারা কি সমাজে প্রতিষ্ঠিত নয় । সন্তান প্রত্যাশিত রেজাল্ট করেনি , তাই বলে রিমাইন্ডে নেয়া আসামীর মত করে তার সাথে জেরা করবেন , তাকে নির্যাতন করবেন , হুমকি ধামকি দিবেন তা তো ভারী অন্যায় ,চরম অনৈতিক । ভেবে দেখুন , আপনারা সন্তানের অভিভাবক , আপনার সন্তানকে প্রচলিত পরীক্ষা হয়তো যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছে না , প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা আপনার সুস্থ সন্তানের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিয়েছে , কিন্তু আপনি তো জানেন , শিশু বয়স থেকে তার মন ,মেধা , প্রতিভা আপনি পর্যবেক্ষণ করছেন , আপনি জানেন আপনার সন্তানের সুপ্ত প্রতিভা কোনদিকে লুকিয়ে আছে । আপনার মেয়ে হয়তো একাডেমিক নয় , কিন্তু ইন্টেরিওর ডিজাইনে রয়েছে তার দক্ষতা , আপনি তার মেধাকে আপনার সস্নেহ সহযোগীতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন । আপনার ছেলে হয়তো ভাল আর্ট করে , ভাল ফুটবল খেলে , পাড়ার সকল বিপদে সে সবার আগে ঝাপিয়ে পড়ে । নাইবা পেল জি পি এ ফাইভ , ফোর , তাকে আপনি মহৎ কাজে উৎসাহী করুন । এই করোনা ত্রাসে এমনও অনেক উদাহরণ আমরা দেখেছি, ডিগ্রিধারী ডাক্তার পরিবার নিয়ে ঘরে বসে ফ্যানের বাতাস খাচ্ছেন অথচ পাড়ার সেই দুষ্টু ছেলে যার নেই কোন ডিগ্রী সে দাফন কাফন করছে করোনা আক্রান্ত লাশকে । আপনার ছেলে হয়তো ভাল রেজাল্ট করতে পারেনি তাতে কি , তাই বলে কি আপনার মনে হচ্ছে আপনার ছেলে কিছুই করতে পারবে না , এখন সে ব্রীজের উপরে রিক্সা ঠেলবে , অথবা আপনার মেয়ে তানিয়া এখন নির্যাতিত গৃহবধু হবে ।না, তা কিন্তু মোটেই নয় । আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতী খুব সীমিত কিছু বিষয়ের বিচারে নির্ভরশীল । মাত্র কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে ফলাফল ঘোষণা করা হয় । কিন্তু এই জীবন বহুমাত্রিক বিষয়ে পরিপূর্ণ , জীবনের অধ্যায় অনেক বিশাল । তানিয়া বারিষ্টার হতে না পারলে কি হবে ; মনে হয় জীবন তার জন্য পরিকল্পনা করেছে আরও বিশাল কিছুর । সে হযতো বিশাল কোন উদ্যোক্তা হবে ,হযতো তার জন্য কাজ করবে বাঘা বাঘা বারিস্টাররা । আমি ব্যাক্তিগতভাবে এমন সব সফল মানুষদের চিনি যাদের মেট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েট এ চমৎকার ভাল কোন রেজাল্ট হয়নি অথবা তারা ক্লাশ এইট , নাইন পর্যন্ত পড়েছেন ,কিন্তু একসময় তারা নিজস্ব মেধা আর পরিশ্রমে হয়েছেন একজন দক্ষ ইনভেস্টর । তাদের কোম্পানীতে এখন শত শত লোক চাকুরী করছে , অনেক BBA , MBA , তাদের কোম্পানীতে জবের জন্য এপ্লাই করছে । এইসব মানুষদের ভাষ্য হল , আত্মবিশ্বাস ,পরিশ্রম আর প্রকৃতিগত মেধা থাকলে একজন মানুষ অনেক কিছু করতে পারে । এস . এস.সি , H.S.C এর রেজাল্ট শিক্ষাজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ , তবে এই রেজাল্টই জীবনের সকল সুখ, সমৃদ্ধি আর সৌভাগ্যের উৎস নয় । সন্তানের জন্য প্রার্থনা করুন সে যেন নিরোগ , সুখী, মানবিক জীবন উপভোগ করতে পারে । ভূল শিক্ষা পদ্ধতি আর পরীক্ষা নামক কিছু প্রহসনের যাতাকলে পিষ্ঠ করে কোমলমতি শিশুদের উচ্ছল শৈশব যাতে কেড়ে নেয়া না হয় ,বিভীষিকাময় করা না হয় ।আমাদের দরকার এখন সেই ধরনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির নিরন্তর গবেষণা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন যার ফলে ছাত্ররা মানবিক শিক্ষা ও কর্মমূখী শিক্ষায় নিজের চেতনা , বিবেক ও মেধাকে জাগ্রত করতে পারে ।
নাজরাতুন নাঈম ইসলাম
প্রাক্তন প্রভাষক
সিলেট সরকারী মদনমোহন বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজ
naznayem@ ymail.com