লকডাউন আমার কাছে নতুন কিছু নয়
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:০০:৫৪,অপরাহ্ন ১১ জুন ২০২০ | সংবাদটি ১০৩০ বার পঠিত
আমার সাথে হায়দ্রাবাদের এক মুসলিম মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল , সে মাত্র কয়েকমাসের জন্য বেড়াতে এসেছিল । আমাদের সামার হাউস তারা কয়েক সপ্তাহের জন্য নিয়েছিল । সে ছোট ছয় মাসের বাচ্চা নিয়ে এসেছিল , কিন্তু সারাদিন সে ঘরের ভেতরই থাকতো ,কোথাও যেত না , তার স্বামী ব্যাবসার কাজে এসেছিলেন , যখন কাজ শেষ হল তারা চলে গেলো ।কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে মেয়েটা আমার সাথে যোগাযোগ রাখে ।, আমার মোবাইল নষ্ট ,তাই সে ম্যাসেন্জারে কল করলো । বললাম এই লক ডাউনে কেমন আছো, বলল সবসময়ের মত ভালই আছি , কারণ আমার সারাজীবনটাই লক ডাউন । আমি সারা জীবন হোম কোয়ারেন্টাইনে , যদিও এখন ২০২০ সাল , তাই এই অবস্থায় আমি অভ্যস্থ । আমি বাবার বাড়ীতে ছিলাম লক ডাউনে ,শশুরবাড়ীতেও আছি হোমকোয়ারেন্টাইনে । কারণ যদিও সে ক্যাপিটেল সিটিতে থাকে বিয়ের আগে সবসময় ছিল সুশৃঙ্খল নিরাপত্তাবলয়ে । তার মা, বাবা কখনও তাকে স্কুল ছাড়া কোথাও যেতে দিতেন না । তারা তাকে মেয়েদের স্কুলে ড্রপ করতেন আবার নিয়ে আসতেন । ঘরে প্রাইভেট শিক্ষক এসে পড়াতেন । কখনও তাকে tution সেন্টারে যেতে দিতেন না । যেই সে ইন্টারে উঠলো তাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন । শশুরবাড়ীর সবাই তার ভাল কিন্তু শশুর শ্বাশুড়ী একটি ব্যাপারে কড়া , কোথাও একা যেতে পারবে না , কোথাও যেতে হলে ঐ এক সপ্তাহ আগে বলতে হবে , এমনকি বাবার বাড়ী যেতে হলে বাবা , ভাইরা হুটহাট করে নিতে পারবেন না ।এক মাস আগে বা মিনিমাম সপ্তাহ দশদিন আগে জানিয়ে শশুর, শ্বাশুড়ী , স্বামী সবার সম্মতিক্রমে ,আলোচনা সাপেক্ষে কতদিন গিয়ে সে থাকবে, কি কারণে যাবে , সব বিবেচনা করে যদি উনাদের অনুমতি মিলে তো যেতে পারবে । আর এই মামাতো বোনের বিয়ে , খালাত, চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে ওসবে যাওয়া যাবে না । যদি যেতেই হয় শুধু তার বাবা বললেই হবে না , যার ছেলের বিয়ে অর্থাৎ চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে হলে বাবাকেসহ চাচাকে স্বশরীরে তার শশুরবাড়ী গিয়ে , অনেক্ষণ বসে , মিনতি করে তার শশুরকে বলে তবেই ছুটি মন্জুর করার জন্য চেষ্টা করতে হবে । তার উপর সে যদি একসপ্তাহের জন্য বাবার বাড়ী যায় সারাঘরের সবার কাপড় ধুয়ে , আয়রন করে রেখে , সাত দিনের রান্না ফ্রিজে রেখে তারপর যেতে হবে । ঘরে তিনটি ননন্দ আছে , শাশুড়ী আছেন তারা করবেন না । সে ও তার ননন্দরা কখনও শপিং মলে যায় না , তার শশুরের কড়া বারণ । তার একটি দেবর বেশ স্মার্ট । সে ঈদের সময় অনেকগুলো কাপড় নিয়ে আসে , এখন ডিজিটাল হওয়ায় ওয়াট্সেপে দেখায় ,তারা ননন্দ ভাবীরা পছন্দ করে অর্ডার দেয় । এখন মাঝে মাঝে তার মেঝ ননন্দ অনলাইনে অর্ডার দিয়ে, বাবাকে অনুরোধ করে বাবার কার্ড নিয়ে সবার জন্য কেনাকাটা করে ।সে বলল তার নিজের তেমন লাক্সারী কাপড় লাগে না কারণ বৎসরে বড়জোর দুইবার সে যায় বাবার বাড়ীতে , তাও দুই ঈদের পরে । তার শশুরমশাই এত বেশী তাদের নিরাপদ রাখেন যে সব আত্মীয়ের দাওয়াতে ও তাদের যেতে দেন না। খুব নিকটআত্মীয় চাচা শ্বশুরের ছেলের বিয়েতে সে একবার গিয়েছিল । ফুফু শাশুড়ী , খালা শাশুড়ীরা দূরে থাকেন বিধায় তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়েতে সে যায়নি । এমনকি তার শশুরবাড়ীতে সামনের বড় রোমে , সামনের উঠানে তার যাওয়ার অনুমতি নেই । পেছনের উঠানে ও সে যেতে পারবে না , একবার সে ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছিলো , ভেবেছিল নাগামরিচ মিশিয়ে খাবে , তাই সে পেছনের উঠোন থেকে নাগামরিচ আনতে গিয়েছিল , তার শশুর পেছনের বেলকনিতে তখন হাটছিলেন , এটা তার চোখে পড়েছিল , তিনি সাথে সাথেই নাগামরিচের গাছটা কেটে ফেলেছিলেন এবং পরে তার শাশুড়ী তাকে কড়া ভাষায় বলেছিলেন লেবু ,কাচামরিচ দরকার পড়লে যেন তাকে বলে এইভাবে ঘরের বাইরে সে গেলো কেন? তার শশুরমশাই খুব রাগ করেছেন । সে শুধু তার রান্নাঘরে আর তার ছোট বেডরুমে চলাফেরা করতে পারে , এটাচ ওয়াশরুম থাকায় তার আর কোন রুমে যেতে হয় না । আর বলল ওর স্বামী ওর শশুরের ব্যবসা দেখাশুনা করেন , কিন্তু সব উপার্জন তার শশুরের হাতে থাকে । তার হাতে বা তার শাশুড়ী ননদের কোন ব্যাংক কার্ড বা নগদ কোন পয়সা নেই । তার স্বামীর কাছেও খুব সামান্য প্রয়োজনীয় খরচের পয়সা থাকে । সে বলল , সে এভাবেই থেকে অভ্যস্থ ।এখন কেউ তাকে বাইরে নিয়ে যেতে চাইলেও সে ইন্টারেস্ট ফিল করে না , এক ধরনের ভয় কাজ করে । তার ঘরে শাশুড়ী আর নন্দরাও অভ্যস্থ , কারও কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না , শুধু ইদানিং মেঝো ননন্দটা কলেজে উঠেছে , মাঝে মাঝে সে তার বাবার নিয়মকানুনের বিরোধীতা করে , মাঝে মাঝে লুকিয়ে সে শপিং মলে যায় । তার বড় ননন্দ আর শাশুড়ী জানেন না ব্যাপারটা , কারণ তারা জানলেই শশুরের কাছে বলে দিবেন তাতে তার মেজ ননন্দের কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে ।সে আর ছোট ননন্দ জানে কারণ মেজ নন্দের এই পারিবিরিক লকডাউনের প্রতিবাদের তারাও সমর্থক । মেঝ ননন্দ তাকে বলল , ভাবী আমাকে শুধু কলেজে পড়লেই হবে না , আমাকে স্বনির্ভর হতে হবে । চল তুমি আমি মিলে অনলাইন বিজনেস শুরু করি । সে বলল , আব্বা কি দিবেন আমাদের , সে বলল তোমাকে তো বাইরে যেতে হবে না , আমি সব বাইরের ব্যাপার এখন যেমন লুকিয়ে করি এভাবেই করব । শুধু ডিগ্রী নয় , আত্মনির্ভশীন না হলে সবসময় হোমকোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে । ছোট বোন আর ভাবীকে বলল , তোমরা শুধু আমার পাশে থেকো ,দেখো ভাবী তোমাকে আর আইসোলেটেড হতে হবে না , তোমার যখন খুশী তখন তোমার মা বাবাকে দেখতে পারবে , আর নয় হোম কোয়ারেন্টাইন , এই লক ডাউন যে করেই হোক উঠাতে হবে ।
Nazratun Nayem Islam
প্রাক্তন প্রভাষক ,
সিলেট মদনমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
ফাইন্যান্স সেক্রেটারী: নারীদিগন্ত
naznayem@ymail.com